শুক্রবার, ২৭ Jun ২০২৫, ০৬:১৬ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

রাজমহলে নারীদের ধর্মীয় শিক্ষিকা

নাহিদ হাসান:
ইতিহাসের পাতায় অনেক পুরুষ মনীষীর নাম উজ্জ্বলভাবে থাকলেও সময়ের গহ্বরে হারিয়ে যাওয়া বহু নারী মনীষী আছেন, যাদের অবদান ছিল অনন্য, যাদের ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়। তেমনই একজন ছিলেন আমাতুল লতিফ বিনতে নাসিহ (রহ.), যিনি ছিলেন হাম্বলি মাজহাবের এক উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা। ইসলামি জ্ঞানচর্চা, আধ্যাত্মিক সাধনা ও সমাজসেবায় যার নাম ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছে। অথচ তার জীবন কাহিনি খুব কমই আলোচিত হয়। তিনি ছিলেন একাধারে একজন ফকিহ (ইসলামি আইনবিদ) এবং আধ্যাত্মিক পথের নিষ্ঠাবান পথিক। তিনি আইয়ুবীয় রাজমহলে নারীদের ধর্মীয় শিক্ষিকা ছিলেন।

তিনি এমন এক যুগে ধর্মচর্চা করেছেন, যখন নারীশিক্ষা ছিল সীমিত। কিন্তু আমাতুল লতিফ (রহ.) সেই প্রথাগত সীমারেখা অতিক্রম করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন একজন জ্ঞানী ও প্রভাবশালী নারী হিসেবে। তার পূর্বপুরুষরা যেমন ধর্ম ও জ্ঞানচর্চায় ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ, তেমনি আমাতুল লতিফ (রহ.)-ও উত্তরাধিকার সূত্রে সেই ঐতিহ্য ধারণ করে এগিয়ে গিয়েছেন। তার জীবনাচার, জ্ঞানসাধনা ও জ্ঞানদানের মতো কাজগুলো তৎকালীন নারীদের ঐতিহ্যবাহী ভূমিকার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বিশেষ করে রাজপরিবারে তার সম্মানজনক অবস্থান এবং হাম্বলি মাজহাবকে শিক্ষাক্ষেত্রে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ প্রমাণ করে তিনি কেবল একজন পাণ্ডিত্যপূর্ণ নারীই ছিলেন না; ছিলেন চিন্তাশীল, কৌশলী ও কর্মনিষ্ঠ একজন সংস্কারকও। এখানে তার জীবনের নানা দিক তুলে ধরা হলো।

তিনি ছিলেন তাপসী নারী ও সালাহুদ্দিন আইয়ুবি (রহ.)-এর বোন রাবেয়া খাতুন (রহ.)-এর সহচর ও সঙ্গী। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি আইয়ুবীয় রাজবংশের আমির এবং হিমস ও তাল-বাশিরের শাসক মুসা ইবনে ইব্রাহিমের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।

আমাতুল লতিফ (রহ.) ছিলেন একটি ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি পরিবারের সন্তান। যারা ধর্মীয় জ্ঞানচর্চা ও বহুমুখী দ্বীনি খেদমতের জন্য বিখ্যাত। আরব বিশ্বের রাজনীতিতেও তাদের জোরালো প্রভাব ছিল। তারা বহু মাদ্রাসা ও জ্ঞানকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছেন। অসংখ্য ধর্মীয় গ্রন্থ রচনা করেছেন, বিশেষ করে ফিকহে হাম্বলির ওপর তাদের অনবদ্য সব রচনা রয়েছে।

তার জন্মতারিখ সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না। তিনি সাদ ইবনে উবাদা (রা.)-এর বংশধর ছিলেন। তাদের পূর্বপুরুষরা মদিনায় বসবাস করতেন। সেখান থেকে তারা সিরাজে চলে যান। সেখান থেকে শামে চলে আসেন এবং সেখানেই খ্যাতি অর্জন করেন।

তার দাদার দাদা আবুল ফারাজ আবদুল ওয়াহেদ ইবনে মুহাম্মদ সিরাজি (রহ.) ছিলেন বিশিষ্ট ফকিহ, ওয়ায়েজ ও লেখক। প্রাথমিক জীবনে তিনি বায়তুল মুকাদ্দাসে বসবাস করতেন। সেখান থেকে দামেস্ক গমন করেন। তিনি ‘শায়খুশ শাম’ উপাধিতে ভূষিত হন। হাম্বলি মাজহাবের প্রভাবশালী আলেম হওয়ার কারণে তাদের পরিবারকে ‘বায়তু ইবনিল হাম্বলি’ নাম দেওয়া হয়। তার দাদা নাজাম ইবনে আবদুল ওয়াহাব (রহ.) সুলতান সালাহুদ্দিন আইয়ুবি (রহ.)-এর বন্ধু ও সহচর। তার পিতা নাসিহুদ্দিন আবদুর রহমান (রহ.)-ও ছিলেন বিশিষ্ট ফকিহ, মুহাদ্দিস, ওয়ায়েজ, লেখক, ঐতিহাসিক ও বীর যোদ্ধা। তাকে ‘শায়খুল হানাবিলা’ উপাধি দেওয়া হয়েছিল। তিনি ‘ইবনুল হাম্বলি’ নামেও প্রসিদ্ধ। শায়খ নাসিহুদ্দিন (রহ.) ঐতিহাসিক হিত্তিন যুদ্ধে এবং বায়তুল মুকাদ্দাস বিজয়ের অভিযানে সালাহুদ্দিন আইয়ুবি (রহ.)-এর সঙ্গে অংশগ্রহণ করেন।

আমাতুল লতিফ (রহ.) কর্মজীবনে রাবেয়া খাতুন (রহ.)-এর সেবায় নিয়োজিত ছিলেন। তিনি রাজমহলের নারীদের কোরআন, হাদিস ও ফিকহের পাঠদান করতেন। রাবেয়া খাতুন (রহ.) তাকে ভালোবাসতেন তার জ্ঞান ও প্রজ্ঞার জন্য। তিনি তার পরামর্শ গ্রহণ করতেন, তার কথা রাখতেন। আমাতুল লতিফ (রহ.)-এর জন্য রাবেয়া খাতুন (রহ.) হাম্বলি মাজহাবের অনুসারীদের জন্য একটি পৃথক মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। আমাতুল লতিফ (রহ.)-এর প্রতি অগাধ বিশ্বাস থাকায় তিনি তার কথা অনুসারে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেন। যার বেশির ভাগ আমাতুল লতিফ (রহ.) মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠার কাজে ব্যয় করেন। তার প্রতিষ্ঠিত কয়েকটি মাদ্রাসা হলো মাদ্রাসাতুল হাদিস, মাদ্রাসাতুস সাহিবাহ, মাদ্রাসাতুর রিবাত ইত্যাদি। ৬৪৩ হিজরিতে রাবেয়া খাতুন (রহ.) ইন্তেকাল করলে তিনি কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হন। তিন বছর তাকে একটি দুর্গে বন্দি করে রাখা হয়। বন্দিজীবন থেকে মুক্তিলাভের পর তিনি বিয়ে করেন এবং স্বামীর সঙ্গে হিমসে চলে যান।

আল্লামা ইবনে কাসির ও আল আলাম গ্রন্থকারসহ ঐতিহাসিকরা লেখেন, তিনি একাধিক গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। কিন্তু ইতিহাসের বর্ণনায় কেবল দুটি বইয়ের নাম খুঁজে পাওয়া যায়। তা হলো ‘কিতাবুত তাসদিদ ফি শাহাদাতিত তাওহিদ’ এবং ‘কিতাবু বিররিল ওয়ালিদাইনি’। বাকি রচনাগুলো কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে।

৬৫৩ হিজরিতে (১২৫৫ খ্রিস্টাব্দে) মহান এই নারী রাহবা নামক স্থানে ইন্তেকাল করেন। তাকে মাদ্রাসাতুল হাদিসের পাশে সমাহিত করা হয়। মৃত্যুর সময় তিনি বিপুল পরিমাণ সম্পদ রেখে যান। যার আর্থিক মূল্য ছিল ৬ লাখ রৌপ্য মুদ্রার সমান। এ ছাড়া তিনি বিপুল পরিমাণ স্থাবর সম্পদও দান করে যান। মহান আল্লাহ এই মহীয়সী নারীকে জান্নাতে সুউচ্চ মাকাম দান করুন। তার কর্মময় জীবনী থেকে মুসলিম নারীদের শিক্ষাগ্রহণ করা উচিত। তাহলে বর্তমান সময়ের নারীদের দুনিয়া ও আখেরাত উজ্জ্বল হবে। মহান আল্লাহ সেই তওফিক দান করুন। (সিয়ারু আলামিন নুবালা, তারিখুল ইসলাম)

ভয়েস/আআ

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION